কঙ্গেলি ধারার লাইহারাবাউবা নৃত্য

লাইহারাউবা মণিপুরী নৃত্য
মণিপুরী নৃত্যশেলীর একটি প্রাচীন ধারা।

 

মণিপুরের সাঙ্গীতিক ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। এই নৃত্যকে মণিপুরের সুপ্রাচীন নৃত্যধারা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

মৈতৈ তথা মণিপুরী ভাষায় 

মণিপুরের সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় লোককাহিনী হলো- খাম্বা-থৈবী উপখ্যান। কথিত আছে রাজা লয়াম্বার রাজত্বকালে (১১২৭-৫৪ খ্রিষ্টাব্দ) খাম্বা এবং থৈবী জীবিত ছিলেন। এঁদেরকে শিব ও পার্বতীর অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। এই কাহিনি মতে- খাম্বা ছিলেন দরিদ্র কৃষকের পুত্র এবং থৈবী ছিলেন রাজকন্যা। লাইহারাউবা নৃত্য উৎপত্তি ঘটেছিল এঁদের প্রণয়োপখ্যান অবলম্বনে।
 

খাম্বা থৈবী উপাখ্যান
মণিপুরের রাজা লায়াম্বার রাজত্বকালে (১১২৭-৫৪ খ্রিষ্টাব্দ), রাজধানী ইম্ফল থেকে প্রায় ত্রিশ মাইল দূরে, মৈরাঙ নামক এক গ্রামে খাম্বা নামক এক দরিদ্র এবং সাহসী যুবক বাস করতেন। মৈরাঙ রাজবংশের থৈবী নামক এক রাজকন্যা একবার লোগতাক হ্রদে সহচরীদের নিয়ে মৎস্যশিকারে যান। রাজার আদেশে ওই স্থানে কোনো পুরুষ লোকের প্রবেশ নিষেধ ছিল। খাম্বা প্রভু থানজিং কর্তৃক স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে ওই সময়ে  লোগতাক হ্রদে যান। সেখানে রাজকন্যা থৈবীর সাথে খাম্বা দেখা হয় এবং উভয় উভয়কে দেখে মুগ্ধ হন এবং প্রণয়াসক্ত হন। সামাজিক বৈষম্যের কারণে উভয়ের বিবাহ প্রায় অসম্ভব ছিল।  প্রথম দিকে রাজরোষে বহুবার তাঁর জীবন বিপন্ন হয়। থৈবীকেও কিছুদিন দাসীবৃত্তি করতে হয়। শেষ পর্যন্ত রাজা উভয়ের বিবাহে সম্মতি দেন। বিবহের কিছুদিন পর, খাম্বা থেবীকে সন্দেহ করা শুরু করে। তৎকালীন মণিপুরের রীতি অনুসারে সতী পরীক্ষার রীতি ছিল। কোনো বিবাহিত নারীর ঘরের দরজার ফাঁক দিয়ে অন্য কোন পুরুষ বর্শার অগ্রভাগ প্রবেশ করালে, ওই নারী যদি বর্শাটি টেনে ঘরের ভিতর রাখে, তবে ওই নারীকে অসৎ বিবেচনা করা হবে। আর ওই স্ত্রীলোক যদি বর্শা গ্রহণ করে, সজোরে ঘরের বাইরে নিক্ষেপ করে, তবে সে সতী বিবেচিত হবে।

 

খাম্বা এই পরীক্ষার জন্য থৈবীকে দূরের গ্রামে যাবে বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যান। রাত্রিবেলা খাম্বা ফিরে এসে থৈবীর ঘরের দরজা দিয়ে বর্শার অগ্রভাগ প্রবেশ করিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন। থৈবী এই বর্শা নিয়ে সজোরে বাইরে নিক্ষেপ করলে, ওই বর্শা খাম্বার বুকে বিদ্ধ হয় এবং ওই আঘাতে তাঁর মৃত্যু হয়। ঘরের বাইরে এসে থৈবী এই দৃশ্য দেখে, ওই বর্শা নিজের বুকে বিদ্ধ করে আত্মহত্যা করেন। এই করুণ কাহিনী অবলম্বনে মৈরাঙ গ্রামে প্রতিবৎসর লাইহারাউবা নৃত্য-আলেখ্য অনুষ্ঠিত হয়। মণিপুরের এই অঞ্চলের মানুষ খাম্বা এবং থৈবীকে শিব-পার্বতীর অংশ হিসেবে পূজা করে।

মণিপুরী ভাষায় লাই শব্দের অর্থ দেবতা। কিন্তু পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে জানা যায়, মণিপুরে লাই বলতে মহাদেবের লিঙ্গ-প্রতিকী রূপকে বুঝানো হয়ে থাকে।

এই সময়ে মণিপুরে শৈব ধর্মের বিকাশ ঘটেছিল। মণিপুরী ভাষায় হারাউবা শব্দের অর্থ হলো-আনন্দনৃত্য। লিঙ্গপূজা এবং এই উপলক্ষে পরিবেশিত আনন্দ নৃত্যই হয়ে উঠেছিল
লাইহারাউবা নৃত্য। মণিপুরবাসীদের ধারণা ছিল- হরপার্বতীর পূজায় ভক্তিভরে নৃত্য পরিবেশন করলে- হরপার্বতীসহ সকল দেবতা তুষ্ট হবেন। ফলে লাইহারাউবা নৃত্য হয়ে উঠেছিল পূজা-পদ্ধতি।

১৭০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে মণিপুর শৈব এবং বৈষ্ণব ধর্মের সহাবস্থানে একটি শান্তির জনপদে পরিণত হয়েছিল।
এরপর ধীরে ধীরে বৈষ্ণবধর্ম মণিপুরের প্রধান ধর্ম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৭০৪ খ্রিষ্টাব্দে রাজা ছরাই রোঙ্গা বৈষ্ণবধর্মকে মণিপুরের রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে ঘোষণা দেয়।

১৭
৯৪ খ্রিষ্টাব্দের দিকে পামহৈবা মণিপুরের রাজত্ব লাভের পর বৈষ্ণবদের আধিপত্য প্রবলতর হয়ে মণিপুরকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। কারণ, রামানন্দীর ভাবদর্শের বিশ্বাসী বৈষ্ণব সাধক শান্তি দাস অধিকারীর অনুপ্রেরণায় রাজা পামহৈবা বৈষ্ণব মত গ্রহণ করেন। এরপর তিনি তাঁর মতকে একরকম জোর করেই মণিপুরে প্রতিষ্ঠা করেন। ফলে এই অঞ্চলে শৈবমতাদর্শের লোকের একরকম কোণঠাসা হয়ে পড়ে। এই সময় রাজা পামহৈবা অন্যান্য মতের গ্রন্থাদি ও নিদর্শন ধ্বংস করে দেয়। এর ফলে মণিপুরের ইতিহাসও ধ্বংস হয়ে যায়।

মণিপুরের বৈষ্ণবরাও দেবতা হিসাবে শিবকে শ্রদ্ধা এবং পূজা করতো। ফলে প্রবল বৈষ্ণব আধিপত্যের যুগেও শিব-পার্বতীর লীলা ভিত্তিক গীত ও নৃত্য বিলুপ্ত হয়ে যায় নি। ফলে 'লাইহারাউবা'- নৃত্য মর্যাদা হারাতে হারাতে প্রায় বিলুপ্তির পথে চলে যায়। রাজা
চন্দ্রকীর্তি সিংহাসনে ১৮৪৪ খ্রিষ্টাব্দে সিংহাসনে বাসার পর তিনি এই নাচকে আবার প্রচলন করেন।

বর্তমানে লাইহারাউবা নৃত্য দুই ভাবধারায় পরিবেশিত হয়। এই ভাবধারা দুটি হলো মৈরাঙ লাইহারাউবা ও উমঙ লাইহারাউবা। এই দুটি ধারাতেই পরিবশিত হয় নানা ধরনের কাহিনি নির্ভর নৃত্যগীত। এর ভিতরে খাম্বাথৈবী, নঙ্‌পক্‌নিঙ্‌থুপানথেবী, থনজিঙ লাইরেম্বী উল্লেখযোগ্য। এই নাচে তাণ্ডব ও লাস্য উভয় ধারাই ব্যবহৃত হয়। এই নৃত্য শৈব নৃত্যধারার হলেও, এতে পরবর্তী সময়ে রাসনৃত্যের ভঙ্গীপারেঙ-এর প্রভাব পড়ে ব্যাপকভাবে।

 

এই নৃত্যধারার সাথে জড়িয়ে আছে, মণিপুরের সনাতন ধর্মে বর্ণিত সৃষ্টিতত্ত্ব। মণিপুরের লোক পুরাণ মতে- নয়জন লাইবুঙথ (দেবতা) এবং সাতজন লাইনুরা (দেবী) পৃথিবী সৃষ্টি করেছিলেন। আদিতে পৃথিবী জলমগ্ন ছিল, আর সেই জলের উপর সাতজন লাইনুরা নৃত্য করছিলেন। এই দৃশ্য দেখে নয়জন লাইবুঙথ স্বর্গ থেকে লাইনুরাদের লক্ষ্য করে মাটি নিক্ষেপ করতে থাকেন। নৃত্যরতা সাতজন লাইনুরা সেই ছুঁড়ে দেওয়া মাটির উপর নেচে নেচে পৃথিবীর স্থলভাগ তৈরি করেন।  এই ভাবনা থেকে লাইহারাউবা নৃত্যের সূচনা হয় 'লাইএকাউবা'। এই নৃত্যে অংশগ্রহণ করেন কিছু দেবদাস এবং দেবদাসী। উল্লেখ্য, মণিপুরে দেবতাদের সেবায় যে পুরুষরা সারাজীবন নিজেদেরকে উৎসর্গ করেন, তাদের বলা হয় মৈবা (দেবদাস)। একইভাবে যে নারীরা দেবতাদের সেবায় সারাজীবন নিজেদেরকে উৎসর্গ করেন, তাদের বলা হয় মৈবী (দেবদাসী)।
 

লাইহারাউবা নৃত্যের অংশসমূহ :

মণিপুরের অঞ্চলভেদে নানা ধরনের লাইহারউবা নৃত্য-উৎসব হয়। তবে প্রধান ধারা হিসেবে বিবেচনা করা হয় ছয়টি ধারাকে। এই ধারাগুলো হলো কঙ্গেলি হারাউবা, চাকপা হারাউবা, অন্ড্রো হারাউবা, সেকমাই হারাউবা, মৈরাং হারাউবা এবং কাকচিঙ হারাউবা।

 

মণিপুরের সবচেয়ে জনপ্রিয় খাম্বা-থৈবীর লোক-কাহিনি অবলম্বনে লাইহারউবা নৃত্য-উৎসব হয়ে থাকে। মণিপুরীরা এই কাহিনীকে জাতীয় উপাখ্যান হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন।

 


সূত্র :